‘হাছন রাজা’ মরমি কবি ও সাধক। তাঁর প্রকৃত নাম ‘দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী’। ১২৬১ বঙ্গাব্দের ৭ পৌষ ১৮৫৪ সালে সিলেট জেলার সুনামগঞ্জে লক্ষ্মণশ্রী গ্রামের এক জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী।
হাছন রাজার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তবে পারিবারিক পরিবেশে তিনি লেখাপড়া শিখেছেন। পনেরো বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ হলে সংসার ও জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত হয়। যৌবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৌখিন ও ভোগ-বিলাসী, কিন্তু পরিণত বয়সে সব বিষয়-সম্পত্তি ত্যাগকরে দরবেশ জীবন যাপন করেন। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় এক হাজার আধ্যাত্মিক/মরমী গান রচনা করেন। স্থানীয় বাউল-ফকিরেরাও সেসব গান গেয়েছে তাঁর সময়ে।
হাছন রাজা ছিলেন একজন ঐশীপ্রেমী এবং সেই প্রেমে মাতোয়ারা হয়েই তিনি গান রচনা করতেন। তাঁর গানে প্রেম, বৈরাগ্যময় আধ্যাত্মিক চেতনা ও অতিন্দ্রিয়ানুভূতির সমন্বয় ঘটেছে। তিনি গানের ভণিতায় নিজেকে ‘পাগলা হাছন রাজা’, ‘উদাসী’, ‘দেওয়ানা’, ‘বাউলা’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন। তিনি কৈশোর ও যৌবনে শ্রীকৃষ্ণের নানাবিধ লীলায় অভিনয়ও করেছেন বলে কথিত আছে।
হাছন রাজার মুখ্য পরিচয় একজন মরমি কবি হিসেবে। তাঁর সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন: ‘পূর্ববঙ্গের একজন গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই যে, ব্যক্তি স্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য।’ গানের ভাষায় তিনি লেখেন……
“মম আখি হইতে পয়দা হইছে আসমান জমিন
শরীর করিল পয়দা শক্ত আর নরম
আর পয়দা করিয়াছে ঠান্ডা আর গরম”
অথবা
রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে,
আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে
হাছন রাজার গানেই তাঁর ভাবনা ও দর্শন চেতনা প্রকাশ পেয়েছে। হাছন উদাস (১৯০৭), শৌখিন বাহার, হাছন বাহার ইত্যাদি গ্রন্থে তাঁর গানগুলি সংকলিত হয়েছে।
হাছন রাজা মুখে মুখে গান রচনা করতেন আর তার সহচরবৃন্দ নায়েব/গোমস্তা সে সব লিখে রাখতেন। তার স্বভাবকবিত্ব এসব গানে জন্ম নিত, তাৎক্ষণিক রচিত তাই কখনো কখনো তার গানে অসংলগ্নতা, গ্রাম্যতা, ছন্দপতন ও শব্দ প্রয়োগে অসতর্কতা লক্ষ্য করা যায়। তারপরও হাছন রাজার গানে অনেক উজ্জ্বল পংক্তি, মনোহর উপমা-চিত্রকল্পের সাক্ষাৎ মেলে। তাঁর কিছু গান, বিশেষ করে ‘লোকে বলে, বলেরে ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার’, ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে’, ‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপরে’, ‘সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইল’, ‘মরণ কথা স্মরণ হইল না হাছন রাজা তোর’, ‘আমি যাইমুরে যাইমুরে আল্লার সঙ্গে’, ‘কানাই তুমি খেইর খেলাও কেনে’, ‘একদিন তোর হইব রে মরন রে হাছন রাজা’- ইত্যাদি লোকপ্রিয় শুধু নয় এর সাহিত্য মূল্যও কম নয়।
১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। বাংলার মরমি সাধনায় হাছন রাজার গান অন্যতম চেতনাবাহী উপাদান হিসেবে চর্চিত।