জননেতা জমিয়ত আলীর জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জে। তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। পেশায় একজন ওষুধ ব্যবসায়ী; কিন্তু নেশা ছিল রাজনীতি। আমার বাবা একজন গ্রাম ডাক্তার ছিলেন। সেই সুবাদে আমি যখন করিমগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেনিতে পড়ি তখন থেকেই জমিয়ত আলীকে চিনি। আমাদের সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ‘বিলাতি’ দুধ দেওয়া হতো। তিনি একটা দুধের প্যাকেট তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এপা, তোমার মায়ের কাছে দিও।’
মুরব্বিদের কাছে শুনেছি, ১৩৫০ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষের সময় তার নেতৃত্বে করিমগঞ্জ ও তাড়াইলে লঙ্গরখানা খোলা হয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দেলন করতে গিয়ে অনেকবার তিনি কারা নির্যাতিত হন। পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে এবং ১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশেও তিনি কারাবরণ করেন। তার সহায়তায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ, খোকা রায়, নগেন সরকার, ওয়ালীনেওয়াজ খান দীর্ঘদিন করিমগঞ্জে আত্মগোপন করে অবস্থান করেন।
১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকালে আমরা ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার অনুরোধ করলে তিনি আমাদের বলেন, ’আমি মূলত কমিউনিস্ট, তবে ন্যাপ করি; আওয়ামী লীগ করা সম্ভব নয়।’ সে বছর তিনি ন্যাপ থেকে কুঁড়েঘর মার্কায় নির্বাচন করেন। উল্লেখ্য, তিনি ১৯৫৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে এবং ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ সালে ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। ১৯৬৪ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে কাজ কাজ করেন।
১৯৬৯ সালে ছাত্র-জনতার ১১ দফা আন্দোলনে কিশোরগঞ্জ মহকুমা ন্যাপের সভাপতি হিসেবে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনেও ছিল তার সক্রিয় অংশগ্রহণ। ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি বাম নেতা কর্মীদের নিয়ে ভারতে চলে যান এবং সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
শুরু থেকেই তিনি শিক্ষার প্রসার ও সংস্কৃতির বিকাশে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫২ সালে করিমগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়টি [বর্তমানে সরকারি] তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। করিমগঞ্জে প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণ করার জন্য যে কমিটি করা হয় তার সভাপতি ছিলেন তিনি। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে যথাসময়ে শহিদ মিনার নির্মিত হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একমাত্র মেয়ে পুতুলের জনক। তার জামাতা আবু সিদ্দীক ছিলেন একজন ভাষা-সৈনিক, বাম রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী।
করিমগঞ্জ উপজেলাকে তিনি আলোকিত করে গেছেন তার কর্মে ও চেতনায়। আমরা যারা তার সান্নিধ্যে এসেছিলাম তারা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করি। তাকে আমরা স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধায়। আর সে লক্ষ্যেই গড়ে তুলি ’জমিয়ত আলী স্মৃতি সংসদ’। স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে ১৯৮৪ সালে থেকে প্রতিবছর করিমগঞ্জের কৃতি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা হয়। নতুন প্রজন্মকে করিমগঞ্জের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানতে হলে জমিয়ত আলী সম্পর্কে জানতে হবে। আমি স্বপ্ন দেখি, এই প্রজন্মের তরুণরা তাদের পূর্বসূরিদের গৌরবগাথা সংগ্রাম ও সততার আদর্শকে ধারণ করে এই জনপদের নেতৃত্ব দেবে এবং সুন্দর আলোকিত সমাজ বিনির্মাণ করবে, যার মূল চেতনা হবে দেশপ্রেম ও মানবতাবোধ। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ করে সারা বিশ্বে উন্নত শিরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হব।