সম্রাট হিরোহিতোর শাসনামলে তাদের মাঝে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। অনেকে বলে থাকেন ‘শোওয়া রেনেসাঁস’ এর উপজাত হিসেবে এই অভ্যাস গড়ে উঠেছে। জাপানিজদের কাজ পাগল জাতিতে পরিণত করতে শোওয়া রেনেসাঁস এর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
তাদের কর্পোরেট সংস্কৃতিতে আজকাল তথাকথিত ‘স্যালারি ম্যান’ শব্দের উদয় ঘটেছে। স্যালারি ম্যান হল সেই ব্যক্তি যিনি কোম্পানির প্রতি অনুগত থাকেন এবং প্রত্যাশা করা হয় তিনি একই কোম্পানিতে জীবনভর কাজ করবেন।
তিনি শুধু অফিসেই দীর্ঘক্ষণ কাজ করেন না,অফিসের বাইরে বসের সাথে, সহকর্মীদের সাথে পার্টিতেও যোগ দিতে হয় তাকে।
জাপানিজরা বছরে মাত্র ২০ দিন ছুটি পায়। অবাক করা তথ্য হল, ছুটির মধ্যেও তারা কাজ করে। কাজের মধ্যে ডুবে থাকাকে তারা জীবনের ধ্যান জ্ঞান বানিয়ে নিয়েছে।
২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০ দিনের মধ্যে তারা অর্ধেক দিন কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিল।
কাজ করতে করতে মারা গিয়েছে এমন উদাহরণও জাপানে নতুন কিছু নয়। এমন মৃত্যুর ঘটনা তাদের কাছে খারোশি নামে পরিচিত।
প্রতি বছর শত শত ‘খারোশি’-র ঘটনা নথিভুক্ত হয়। অনেকে অভিযোগ করেছেন প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি৷
সরকারিভাবে খারোশিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। অবশ্য এমন ঘটনাকে অনেক সময় স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও আত্নহত্যা হিসেবে প্রচার করা হয়।
আত্নহত্যা সেখানকার অন্যতম সামাজিক সমস্যা।বছরে ৩৩ হাজার লোক আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে ২০ থেকে ৪৪ বছর বয়সী লোকের সংখ্যা সর্বাধিক।
অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে সহজ উপায়ে আত্নহত্যা করতে জাপানে ট্রেনিং সেন্টার পর্যন্ত রয়েছে। আত্নহত্যার দিন হিসেবে সোমবার দিনটির বিশেষ খ্যাতি রয়েছে দেশটিতে৷
জাপানের অফিসগুলোতে প্রতি সোমবার সাপ্তাহিক মিটিং হয়। মিটিংয়ে পারফরম্যান্স ভাল না করলে বসের বকা খাওয়াটা স্বাভাবিক।
তবে জাপানিজরা বকা খাওয়ার চেয়ে আত্নহত্যা করে নিজের আত্নসম্মান রক্ষা করাকেই বড় হিসেবে বিবেচনা করেন।
এমন আত্নহত্যার দীর্ঘ রেকর্ড, বর্তমান প্রজন্মের অসন্তোষ সব কিছুকে বিবেচনায় নিয়ে জাপানের সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানিগুলো কর্মঘণ্টা কমাতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
জাপান সরকার বছরে ৫ দিন ছুটি নেয়া বাধ্যতামূলক করে ২০১৬ সালে ‘মাউন্টেইন ডে’ ঘোষণা করে। ২০১৭ সালে ‘প্রিমিয়াম ফ্রাইডে’ নামে বিশেষ একটি উদ্যোগ চালু করে।
‘প্রিমিয়াম ফ্রাইডে’ পালনে কোম্পানিগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়৷ সে অনুযায়ী মাসের শেষ শুক্রবারে কর্মচারীদের দুপুর তিনটার মধ্যেই কাজ থেকে ছুটি দিতে হবে৷ অবসর কাটানোর জন্য, ভোগ্যপণ্য খরচের জন্য বাড়তি অর্থ দিতে হবে।
কিন্তু অধিকাংশ জাপানিজ ‘প্রিমিয়াম ফ্রাইডে’ উদযাপনে সাড়া দেয়নি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রিমিয়াম ফ্রাইডের প্রথম দিনে মাত্র ৪ ভাগ লোক দ্রুত অফিস ত্যাগ করেছিল।
জাপানে দলবদ্ধ কাজকে উৎসাহিত করা হয়, ব্যক্তি উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করা হয়।তাই কেউ একাকী অফিস ত্যাগ করতে চায় না।
২০১৮ সালে শিনজো অ্যাবের সরকার কাজের চাপ কমাতে বিশেষ বিল পাশ করেছিল। বিলটিতে কর্মঘণ্টা, সমান কাজের জন্য সমান বেতন, সাপ্তাহিক কাজের দিন নির্ধারণ সহ অনেক নির্দেশনা ছিল।
সপ্রতি জাপান সরকার সপ্তাহে ৪ দিন কাজ আর ৩ দিন ছুটির প্রস্তাব করেছে। দেরিতে হলেও দেশটির সরকার দীর্ঘ কর্মঘণ্টার কুফল বুঝতে পারছে।
দীর্ঘ সময় কাজ করলেই উৎপাদনশীলতা বাড়বে এমন কোনো কথা নেই। জি-সেভেন ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জাপানে উৎপাদনশীলতা সবথেকে কম।
দেশের উন্নয়নকে জাতীয় স্বপ্ন হিসেবে মনে করে তারা।জাপানের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে প্রত্যেক নাগরিক সমান ভাবে অংশগ্রহণ করতে চায়। বেশি কাছ করার পিছনে বাস্তবিক কিছু কারণও রয়েছে।
২০১১ সালে জাপান, চীনের কাছে অর্থনীতির ২য় স্থান হারিয়েছে। এর আগে ৪২ বছর যাবত জাপান ছিল বিশ্বের ২য় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
পাশাপাশি বর্তমানে তারা শ্রম সংকটে ভুগছে। দেশটির জনসংখ্যা দ্রুত বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সেই তুলনায় জনসংখ্যা বাড়ছে না।
গবেষণার তথ্য বলছে, ২০৬৫ সালে জাপানের জনসংখ্যা হবে ৮৮ মিলিয়ন। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বর্তমানে জাপানের জনসংখ্যা ১২৭ মিলিয়ন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশটি অভিবাসী গ্রহণ ও রোবটিকস ব্যবহার- এই দুই উপায়ে শ্রম সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে।
কিন্তু তারা বরাবরই অভিবাসী গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করে আসছে। বিশ্বের অন্য বড় অর্থনীতির দেশের তুলনায় এখানে অল্প সংখ্যক বিদেশী শ্রমিক রয়েছে।