উজান থেকে আসা প্রবল ঢল ও অকালবৃষ্টিতে যখন সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহের হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে কৃষকের বুক ছিড়ে হাহাকারের বন্যা বইছিল, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং সরকারগঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা এবং স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা তখন বিপন্ন ও অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে তদন্ত কাজের অগ্রগতির জন্য নানাবিধ প্রশ্ন ছুঁড়েছেন যা বিপর্যস্ত কৃষককুলের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। মাঝে মাঝে দেখা গেছে তাঁরা কোদাল কাস্তে নিয়ে মাটি ভরাটের কাজেও নেমে পড়েছেন যা নিতান্তই ‘অসময়ে গীত গাওয়ার’ সমান। (সিলেট অঞ্চলে একটি প্রবাদ আছে ‘সময়ের গীত সময়ে গাইতে হয়’)।
পাহাড়ি ঢলে বোরো ফসল ঘরে তোলা নিয়ে শংকায় রয়েছেন সুনামগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলের কৃষকেরা। বিভিন্ন ‘নরম’ বাঁধ ভেঙ্গে এরই মধ্যে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে পানি প্রবেশ করেছে। সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার বিভিন্ন হাওরেও ঢুকে পড়েছে ঢলের পানি। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার সুনামগঞ্জের কাবিটা নীতিমালা বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যদের সাথে জরুরী বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তিনি হাওরের বাঁধ রক্ষায় দিনের পাশাপাশি রাতের বেলাও মনিটরিং জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকার ছোট বড় হাজার হাজার জলাধার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যাদের মধ্যে অন্যতম হল হাওর। বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুসারে দেশে মোট ৪১৪টি হাওর রয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, বাংলাদেশে হাওরের সংখ্যা ৪২৩টি। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে ১৩৩, সিলেটে ৪৩, হবিগঞ্জে ৩৮, মৌলভীবাজারে ৪, কিশোরগঞ্জে ১২২, নেত্রকোনায় ৮০টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩টি হাওর রয়েছে।
হাওরের দুর্যোগ পুরোপুরি মানবসৃষ্ট। ২০১৭ সালে পাউবোর নীতিনির্ধারকেরা দুদকের কাছে স্বীকার করেছিলেন, তাঁদের কাজে গাফিলতি ছিল। কিন্তু পাউবোর সামান্য গাফিলতি যে হাওরবাসীর জন্য অসামান্য ক্ষতি বয়ে এনেছে, তার জবাব কে দেবে ?
গত ৩০ মার্চ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের পানিতে ইতিমধ্যে সুনামগঞ্জ এবং কিশোরগঞ্জের বেশীর ভাগ হাওরের বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এঘটনার প্রেক্ষিতে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দূর্নীতি অভিযোগ উঠেছে। আর এই ফসলহানির ঘটনায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। সেই তদন্ত কমিটির আহবায়ক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দা সালমা জাফরিন গত মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) সকাল থেকে জেলার ধর্শাপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল হাওরসহ তাহিরপুর উপজেলার হাওরের নজরখালী এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ ও ফসল পরিদর্শন করেন এবং স্থানীয় কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলেন।
এসময় তদন্ত কমিটির সদস্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী এনায়েত উল্লাহ, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোবাশসেরুল ইসলাম, সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) দেবজিৎ সিনহা, সুনামগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আওয়ার উল হালিমসহ সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ জহুরুল ইসলাম সাথে ছিলেন।
এদিকে ফসলহানি এবং বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসনের ৫ সদস্যের আরো একটি কমিটিও কাজ করছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন এই কমিটি করেন। তারা আগামী ২৫ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।
তদন্ত কমিটি জানায়- গত ৩০ মার্চ ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে সুনামগঞ্জ জেলার নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পায়। এরফলে ঝুকিতে পড়ে হাওরের বোরো ফসল। এবং এই অবস্থা অব্যাহত থাকার কারণে গত ২ এপ্রিল সর্ব প্রথম তাহিরপুর উপজেলার নজরখালী বাঁধ ভেঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওরের ফসল ডুবে যাওয়াসহ একের পর এক ছোট-বড় ১০টি হাওরের ফসলহানি ঘটেছে।
তবে হাওর এডভোকেসি প্লাটফর্ম (হ্যাপ) সংগঠনের নেতারা গত ১১ এপ্রিল সোমবার সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ পৌরশহরের মুক্তিযোদ্ধা পাবলিক লাইব্রেরীতে সংবাদ সম্মেলন করে জানান- হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ এখন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কৃষকদের স্বার্থে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা দেয়। কিন্তু যারা বাঁধ নির্মাণের সাথে জড়িত তারা কৃষক নয়। তাই ওরা নিজেদের স্বার্থ বড় করে দেখে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্থানীয় রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মিলে হাওরের বাঁধ নির্মাণ সিন্ডিকেড গড়ে তুলে। একারণে অনিয়ম ও দূর্নীতির মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণের নামে টাকা অপচয় ও লুটপাট হয়। আর কপাল পুড়ে হাওরের কৃষকদের।
বর্তমানে হাওরের কৃষকরা তাদের ফসল রক্ষা করার জন্য নিজ উদ্যোগে বাঁশ, ছাটাই, মাটি দিয়ে বেরী বাঁধ মেরামত করাসহ দিনরাত পাহাড়া দিচ্ছি। আর যারা ফসল হারিয়েছে তাদের মাঝে হাহাকার বিরাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের কান্না কেউ দেখছেনা।
এলাকার প্রভাবশালীরা হাওরের পিআইসি নিজের অধিনে নিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে। একারণে বাঁধের কাজ দায় সারা ভাবে হয়েছে। সময়মতো বাঁধ নির্মাণ শুরু ও শেষ হয়নি, করা হয়নি সঠিক ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকি। এখন পাহাড়ি ঢল আসার পর তাদের দৌড়ঝাপ শুরু হয়েছে। একপক্ষ অন্যপক্ষকে করছে দোষারোপ। এবার সুনামগঞ্জে হাওরের ফসল রক্ষায় ৭২৭টি প্রকল্পে ১২২ কোটি টাকার বাঁধের কাজ হয়েছে। তবে বাঁধের নির্মাণ কাজ সময়মতো শেষ হয়নি। এজন্য প্রশাসন ও পাউবো কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে নিতে হবে আইনগত পদক্ষেপ। কারণ কৃষকদের দাবী ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জ সদর, তাহিরপুর, ধর্মাপাশা, দিরাই, শাল্লা ও ছাতক উপজেলার ছোট-বড় ১২টি হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে প্রায় ২০হাজার হেক্টর বোরো ধান তলিয়ে গেছে। সেই ধান হারিয়ে নিঃস্ব প্রায় কয়েক হাজার কৃষক।
সুনামগঞ্জে এবার ২লাখ ২২হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ১৩লাখ ৫০হাজার ২২০ মেট্রিক টন। কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিটাইমইন এবং নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরীর বেশ কিছু হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে সমস্ত ফসল ইতিমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে।
প্রায় প্রতিবছর হাওরে বন্যা হয়। এর হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হলে স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে। পাউবো বা পিআইসির মাধ্যমে যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলো অস্থায়ী। পাউবো বা পিআইসির মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণে প্রচুর অনিয়ম লক্ষ্য করা যায়। যার দুর্নীতির তথ্য ২০১৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে উঠে আসে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত হাওরঞ্ছলের জনগণ হাওরের বাঁধ ভাঙ্গার করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেয়ে ভালভাবে তাঁদের প্রাণের ফসল ঘরে তুলতে পেড়েছিলেন। চলতি বছরের ৩০ মার্চ থেকে পাহাড়ি ঢল কৃষকদের হৃদয় বিদীর্ণ করে প্রাণের ফসল কেঁড়ে নেয়। ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতিই এজন্য দায়ী বলে ভুক্তভোগীসহ সকলের অভিযোগ।
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। দেশের শতকরা ৮০ জন কৃষক। কৃষকেরা সকলেই গ্রামে বাস করেন। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ কৃষক এখনও আছে কিনা তা বর্তমানে জরিপ ও ও গণনার বিষয়। কৃষকেরা জমিতে কষ্ট ও শ্রম এবং মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হাওড়ে ফসল ফলায়। সেই ফসলেই বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ খেয়ে বেঁচে আছে। বাংলাদেশের মাধ্য সবচেয়ে বেশী ফসল ফলানোর হাওরগুলো সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থান করছে। সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় হাওরগুলো হচ্ছে বিশ্ব বিখ্যাত টাংগুয়ার হাওর, শনির হাওর, হালির হাওর, পাগনার হাওর, দেখার হাওর, নলুয়ার হাওর, কালিয়া বুটা, ছায়ার হাওর, বরামের হাওর এবং আরো ছোট বড় অসংখ্য হাওর রয়েছে। এই সমস্ত হাওরে প্রচুর পরিমানে ধান ফলে। তবে এই হাওরগুলো এক ফসলি হাওর। বোরোধান বলে পরিচিত। যেহেতু এক ফসলি ফসেেলর উপর কৃষকগন নির্ভরশীল সেই জন্যই কৃষকেরা ফাল্গুন চৈত্র মাস অর্থ্যাৎ ইংরেজী ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে খুব বেশী শংকিত থাকে।
হাওর বাঁধ নিয়ে প্রতি বছরই অনেক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন হাওর বাঁধের জন্য প্রধানত দায়িত্ব পাউবোর উপর ন্যাস্ত। পাউবো আবার কাজ দেয় বিভিন্ন নিয়ম কানুনের মাধ্যমে। তারা পিআইসি কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটিতে স্থানীয় সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি সহ বিভিন্ন কোটায় লোকজন থাকতে হবে। এভাবে কমিটি গঠন করতেই অনেক সময় লেগে যায়। কমিটি গঠনের পর যারা কাজ পায় তারা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ২৮শে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে বাঁধগুলো মেরামতের কাজ সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু বাস্তবে সময়মতো বাধের কাজ পওয়া ঠিকাদাররা কাজই শুরু করে না। অনেক সময় দেখা যায় ঠিকাদাররা পাউবোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সাথে হাত মিলিয়ে প্রকল্পের সমস্ত টাকা তোলে নেওয়ার পরও বাধের কাজ কিছুই করে না। আবার অনেক সময় দেখা যায় ঠিকাদাররা সময়মতো বরাদ্দকৃত টাকা না পাওয়ার ফলে কাজ করতে পারে না। এতে হযবরল অবস্থা সৃষ্টি হয়।
সম্প্রতি দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকায় জামালগঞ্জ উপজেলার হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে কৃষকেরা শংকিত খবরটি ছাপা হয়েছ। পাগনা হাওরে ফ্লোজারে ফাটল, মহালিয়া হাওর অরক্ষিত অবস্থায় আছে। জামালগঞ্জ উপজেলার ছোট বড় ৬টি হাওরের ফসল রক্ষার জন্য কাবিটা নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণ, ভাঙ্গন মেরামত কাজে চলতি অর্থ বছরে ৩৬ টি পিআইসি গঠনে অনুমোদন দিয়েছে। এর বিপরীতে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। একই ভাবে সুনামগঞ্জ জেলার ১২ টি উপজেলার হাওরের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে ১৯ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকা।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশী হাওর সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। এবছর ২,২২৬৯৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯,০১৪৮১ মেট্ট্রিক টন ধান। জেলার মোট ৭২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে ১৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার সহ ৫৩২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করার কথা পাউবোর। কিন্তু কোনো উপজেলায়ই এখন পর্যন্ত বাধের কাজ সময় মতো সম্পন্ন হয়নি বলে জেলার কৃষকগণ জানিয়েছেন। যে সমস্ত বাঁধের কাজ ৪০/৫০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে সেগুলোর অতি নিকট থেকে মাটি আনা হয়েছে। বাঁধ গুলো দু পাশে গাছ লাগানো ও দুর্মোজ করা হয়নি বাল স্পোপ দেওয় হয়নি। পাউবোর গাফলাতির জন্য যদি ফসল রক্ষার বাঁধ ভেঙ্গে যায় তাহলে আমাদের কৃষকেরা যাবে কোথায় ?
সুনামগঞ্জের হাওরের পিআইসি গঠনে প্রভাবশালী মহলসহ কর্মকর্তাদের কমিশন বাণিজ্যের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন এলাকার নিরীহ কৃষকরা। দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণে পাহাড়ি ঢল ও সামান্য বৃষ্টির পানিতে একের পর এক হাওরের বাঁধ ভেঙে জেলার ১৫টি হাওরের ৪০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে কৃষকের সারা বছরের স্বপ্নের ফসল বিনষ্ট হয়েছে। চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন হাওর পাড়ের নিম্ন আয়ের কৃষকরা। একবার হাওরের ফসল তলিয়ে গেলে টানা ৪/৫ বছর এর রেশ টানতে হয় কৃষকদের। এর আগেও হাওর ডুবির ঘটনায় অনেকেই ধনী থেকে দরিদ্রে পরিণত হয়ে দেশান্তরী হয়েছেন।
গত ৩০ মার্চ থেকে সুনামগঞ্জের সদর, তাহিরপুর, শাল্লা, দিরাই, ধর্মপাশা, মধ্যনগরের ছোট বড় ১০টি হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসলের ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম, দুর্নীতি আর কমিশন বাণিজ্যের ঘটনা। এসবে কারা কারা জড়িত, কত টাকার বিনিময়ে পিআইসি দেয়া হয়েছে, পিআইসিদের কি আদৌ হাওরে জমি আছে? বাঁধের কী পরিমাণ কাজ হয়েছে, বাঁধে আদৌ কি দরমুজ/কমপেকশন করা হয়েছে, ঘাস লাগানো হয়েছে, বাঁধের প্রকৃত খরচ কত, কোনো জনপ্রতিনিধি বা দলীয় নেতারা কত টাকার বিনিময়ে পিআইসি অনুমোদন পাইয়ে দিয়েছে, প্রকৃত কৃষকদের পিআইসিতে সম্পৃক্ত না করার কারণ, প্রকৃত কৃষকরা টাকার বিনিময়ে পিআইসি নিতে নারাজ, স্থানীয় টাউট দালাল ও ফরিয়াদের খপ্পরে পিআইসি কমিটির অনুমোদনের নামে অগ্রিম ২-৩ লাখ টাকা কমিশন আদায়, গেল বছরের বকেয়া পাওনা বিল কাগজে কলমে পরিশোধ দেখিয়ে ৩০ কোটি টাকা লুটপাট এর সঙ্গে কে কে জড়িত, কারা কারা এ টাকার ভাগ নিয়েছেন তারই খতিয়ান উঠে আসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে। অনেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়ে প্রকৃত সত্য প্রকাশ করতেও ভয় পাচ্ছেন। তাছাড়া পিআইসি প্রাপ্তদের বেশিরভাগই প্রভাবশালী হওয়ায় স্থানীয় কৃষকরা ভয়ে মুখ খুলতে রাজি হয়নি পরবর্তী ঝামেলার ভয়ে। হাওরপাড়ের কৃষকদের একমাত্র সম্বল বোরো ফসল রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে বেরী বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারদের ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির কারণে ২০১৭ সালে জেলার সবকটি হাওর অকাল বন্যায় তলিয়ে খাদ্যহারা হয়ে পড়েন হাওর পাড়ের কৃষক। শুরু হয় দুর্বার আন্দোলন, হাওরের অসহায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের দেখতে হাওর ভ্রমনে আসেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পানি সম্পদ মন্ত্রীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তারা।
অনিয়ম দুর্নীতির কারণে জেলার ১৬জন ঠিকাদার ও পাউবো’র কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয় এবং অনেকেই কিছুদিন জেল খেটে বেরিয়ে এসে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে মামলাটি ধাপাচাপা দেয়ারও অভিযোগ উঠে। তখন হাওরের বাধ নির্মাণে ঠিকাদারী প্রথা বাতিল করে স্থানীয় কৃষকদের সমন্বয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)র মাধ্যমে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজের প্রচলন হয়।
হাওরে বাঁধের কাজের নীতিমালা অনুযায়ী, স্থানীয় কৃষক ও সুবিধাভোগীদের নিয়ে পাঁচ থেকে সাত সদস্যের পিআইসি গঠন করার কথা থাকলেও প্রকৃত পক্ষে স্থানীয় জমির মালিকদেরকে পিআইসিতে সম্পৃক্ত না করে পাউবো’র এসও, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় এমপি’র দালালদের সমন্বয়ে ১-৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে নামকা ওয়াস্তে পিআইসি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অনেকেই জানেন না তার নাম পিআইসিতে অর্ন্তভুক্ত আছে। একটি পিআইসিতে সর্বোচ্চ ২৪,৯৯,৯৯৯ লাখ টাকার কাজ করতে পারবে। গেল কয়েক বছরে হাওরে বন্যা না হওয়ায় অনেক পিআইসি অক্ষত অবস্থায় থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় দেড়গুণ/দ্বিগুণ/তিন গুণ/ বাড়িয়ে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করে জেলার ১২ উপজেলার ৫২টি হাওরের ৫৩৫ কি:মি: বাধ ভাঙ্গা মেরামত/সংস্কার/নতুন বাধ নির্মাণের লক্ষ্যে ৭২৭ প্রকল্পে ১২২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় পাউবো। ইতিমধ্যে কাজের ৩য় বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ৭২৭টি পিআইসির মধ্যে অপ্রয়োজনীয় পিআইসি’র সংখ্যা ২০০টি। হাওরের যে অংশে বাধ প্রয়োজন সেখানে বাধ না দিয়ে অপ্রয়োজনীয় স্থানে বাধের প্রকল্প বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ফলে একশ বাইশ কোটি টাকা ব্যয় করেও হাওরের ফসল রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। অনিয়মের ফলে হাজার হাজার কৃষকের ফসলহানীর দ্বায় কে নেবে ?
গত কয়েক বছর ধরে ফসল ঘরে তুলতে পেরে একট সুখ স্বাছন্দ বোঁধ করছে কৃষকেরা। করোনার কারণে যখন সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ঠিক সেই সময় বাংলাদেশের কৃষকেরা ফসল ঘরে তুলতে পারায় একজন কৃষককেও না খেয়ে মরতে হয়নি বরং কৃষি খাতে ব্যাপক সাফল্যের কারণে অর্থনৈতিক ভাবে কৃষকেরা যেমন স্বাবলম্বী তেমনি ভাবে সরকারের উন্নয়নের চাকা দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে।
কয়েক বছর ধরে কৃষকেরা ফসল ঘরে তুলতে পারায় কৃষকরা স্বাচ্ছন্দে দিনাতিপাত করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাওড়ের উন্নয়নে কৃষিমন্ত্রী ও পরিকল্পনা মন্ত্রীকে মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়াও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই হাওর বাধের কাজ প্রতিবছরই তদারকি করে থাকেন।
কিন্তু পাউবোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ঠিকাদারদের সিণ্ডিকেটের কারনে এ বছর সময় মত হাওর বাঁধের কাজ সম্পন্ন হয়নি যার ফলে এই ফসলহানির ঘটনা ঘটল। আশা ছিল কৃষকেরা এ বছর ও ভালভাবে ফসল ঘরে তুলতে পারবে। তাদের স্ত্রী সন্তানের মুখে হাঁসি ফুটে উঠবে কিন্তু সব কিছুই যেন গুরে বালি। অকাল বন্যায় হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসলহানীর দ্বায়বার কারা নেবে তা অচিরেই খুজে বের করার জন্য সরকারের প্রতি দাবী জানাচ্ছেন অসহায় কৃষকরা।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, হাওর বাঁচলে কৃষক বাঁচবে, কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। আর এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য হাওরে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। একই সঙ্গে উজান থেকে আসা ঢলের পানি যাতে নদী ও হাওর ধারণ করতে পারে, সে জন্য নদী ও বিল খনন করতে হবে। নদীর নাব্যতা বাড়লে বন্যার প্রকোপ কমে যাবে।
বর্তমানে হাওরে যেসব ধান চাষ করা হয়, তা দীর্ঘমেয়াদি। কোনো কোনোটিতে পাঁচ–ছয় মাস পর্যন্ত লেগে যায়। এখন হাওরের উপযোগী স্বল্পমেয়াদি ধান উদ্ভাবন করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে গবেষণা সহায়তা পেলে হাওরের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খায়, এ রকম ধানও উদ্ভাবন করা সম্ভব হতে পারে।
বাংলাদেশের হাওরের মানুষ শত শত বছর ধরে বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার। কিন্তু কোনো সরকারই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নেয়নি। ফল যে হাওর মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রধান সম্বল, সেই হাওরই তাঁদের দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই হাওরের উন্নয়নে নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহন করেছেন। এই মানবসৃষ্ট দুর্যোগের শিকার হাওরবাসী মনে করেন হাওর বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প দুর্নীতিবাজ চক্রের হাত থেকে মুক্ত না হলে প্রতি বছরই এই মানবসৃষ্ট বিপর্যয় ঘটবে যা থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় থাকবেনা। আর হাওরের কান্নাও কখনও থামবেনা।