নব্বইয়ের দশকের আনাড়ি আফগান মুজাহিদীন ও আজকের তা লে বা ন এক নয়। আজকের তা লে বা ন অনেক অভিজ্ঞ ও পরিপক্ক!
২০২০ সালের বিশেষ দিনে ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের রাজধানী দোহায় তা লে বা ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে প্রায় দুই দশকের আফগান মিশন সমাপ্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে আমেরিকা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আফগানিস্তানে পরাজয় ঘটেছে আমেরিকার। কার কাছে পরাজিত হয়েছে আমেরিকা? পুরো আফগান জাতির কাছে? না, একটি সশস্ত্র মুজাহিদ গ্রুপ তা লে বা নের কাছে পরাজয় ঘটেছে তাদের। আফগান তা লে বা নের কাছে আমেরিকা যেমনি প্রথম দেশ হিসেবে পরাজিত হয়নি তেমনি এটা তাদের প্রথমবারের মতোও পরাজয় নয়। এর আগে প্রথম দেশ হিসেবে সোভিয়েত বা বর্তমান রাশিয়া পরাজিত হয়েছিল আফগানে।আবার আমেরিকা আফগানিস্তানেরও অনেক আগে ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল।
ভিয়েতনাম যুদ্ধকে আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধও বলা হয়ে থাকে। এর স্থায়ীত্ব কাল ও ছিল ২০ বছর অর্থাৎ ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভিয়েতনাম যুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সহায়তা নিয়ে আমেরিকাকে হটাতে সক্ষম হয়েছিল ভিয়েতনাম। অনুরূপভাবে আমেরিকা ও পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সহায়তা নিয়ে রাশিয়াকে হটিয়ে ১৯৮৮ সালে বিজয় লাভ করেছিল তত্কালীন আফগান মুজাহিদীন। এ দুটি ঘটনাই ঘটেছে কোল্ড ওয়ার বা আমেরিকা-সোভিয়েতের মধ্যকার ঠান্ডা যুদ্ধ কালীন সময়ে। কিন্তু বর্তমান তা লে বা নে র বিজয় সম্পুর্ন ভিন্ন। কারন এ বিজয়ে পৃথিবীর কোনো দেশ প্রত্যক্ষ সহায়তা করেনি তাদের। তাঁদের রণকৌশল, কুটনীতি, প্রজ্ঞা ও ধৈর্যের কারনে আবার বিজিত হওয়ার পথে। তাঁদের একক নৈপুণ্যে এ বিজয় প্রমাণ করে নব্বইয়ের দশকের আনাড়ি আফগান মুজাহিদীন ও আজকের তা লে বান এক নয়। আজকের তা লে বান অনেক অভিজ্ঞ ও পরিপক্ক। তাঁরা এখন জানে একটি দেশ পরিচালনায় প্রয়োজনীয় উপাদান কি। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের পাবলিক ডিলিংস, ঐতিহাসিক ১৩ দফা ও অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপ তা প্রমাণ করে।
১৯৯৬ সালে প্রেসিডেন্ট বুরহানউদ্দীন রাব্বানির সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা করে তা লে বান। বুরহানউদ্দীন রাব্বানী ছিলেন সাবেক আফগান মুজাহিদীনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। ক্ষমতা গ্রহনের পরে কিছু কিছু বিষয়ে জনগণের দ্বিমত থাকলেও দুর্নীতি বিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে দিনে দিনে আফগান রাজনীতিতে জনপ্রিয়তা পায় তা লে বান। সোভিয়েত পরবর্তী তা লে বা নের উত্থানে সৌদি পেট্রো ডলার ও পাকিস্তানের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাকিস্তান না হয় তাঁর সীমান্ত ঘেঁষা আফগান রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ ও বেলুচিস্তানের অক্ষুন্নতা টিকিয়ে রাখতে তা লে বানের উত্থানে সহযোগী ছিল। কিন্তু সৌদির স্বার্থ কি ছিল এখানে? একেতো তা লে বানকে দেওয়া সৌদির অধিকাংশ ফান্ড ছিল আনঅথরাইজড। আর অথরাইজড রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা যা ছিল তার একটি অন্যতম কারন হতে পারে শিয়া রাষ্ট্র ইরানের সীমান্তে সৌদির প্রক্সি তৈরি করা।
নাইন ইলেভেন এর ঘটনার পর আল কায়েদা নেটওয়ার্ক কে সহযোগিতা ও আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠে আফগান তা লে বানের উপরে। সৌদির মধ্যস্থতায় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে ব্যর্থ হয় আমেরিকা। এ ঘটনা ১৯৯৩ সালে স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের ক্লাশ অব সিভিলাইজেশনের কথা মনে করিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রকে। হান্টিংটনের পূর্বে তার শিষ্য ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের (১৯৯১) পর ১৯৯২ সালে লিখেন The End of History and the Last Man. তিনি এখানে মোটা দাগে বুঝাতে চেয়েছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে বাইপোলার বিশ্ব এখন শুধুমাত্র আমেরিকার নেতৃত্বে ইউনিপোলার বিশ্বে পরিনত হয়েছে। আমেরিকার লিবারেল ডেমোক্র্যাসি এখন চূড়ান্ত লেভেলে অবস্থান করছে যার ফলে প্রতিটি দেশ বিকল্প অন্য কিছু চিন্তা করা কঠিন। আর প্রকৃত গনতান্ত্রিক দেশের পক্ষে একে অপরে যুদ্ধ জড়ানো অসম্ভব। এটা তার Democratic peace theory নামেও পরিচিত। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন ‘The end of history means the end of war’. তাঁর একবছর পরে অর্থাৎ ১৯৯৩ সালে হান্টিংটন তার Clash of Civilizations এর মাধ্যমে বলতে চেষ্টা করেছেন পৃথিবীতে কখনো যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে না। বরং যুদ্ধের ডাইমেনশনস চেঞ্জ হবে। এখন দেশে দেশে যুদ্ধ না হয়ে সভ্যতা (ধর্ম ও সাংস্কৃতির) মধ্যে সংঘাত হবে।
তিনি সারা পৃথিবীকে মেজর আটটি সভ্যতায় বিভক্ত করেছেন। এবং ‘ওয়েস্ট ভার্সেস রেস্ট’ বলে সকল সভ্যতা থেকে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকাকে আলাদা করে দেখিয়েছেন। পশ্চিমা বিশ্বের জন্য পটেনশিয়াল থ্রেট হিসেবে উল্লেখ করেছেন মুসলিম বিশ্ব ও ইষ্টান ওয়ার্ল্ড এর বুদ্ধিস্ট চায়নাকে। তাঁর এ চিন্তার সমালোচনা করেছেন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এ্যাডওয়ার্ড সাঈদ। আরব-আমেরিকিন সাঈদ তাঁর ‘ ক্লাশ অব ইগনোরেন্স’ আর্টিকেল এ উল্লেখ করেন “হান্টিংটনের ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন একটি বিশুদ্ধতম হিংস্র বর্ণবাদ, হিটলারীয় বিজ্ঞানের এক ধরণের প্যারোডি যা আজ আরব ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে”।
২০০১ সালে সকল সমালোচনা থোরায় কেয়ার করে বুশ প্রশাসন হান্টিংটনের চিন্তা মাথায় নিয়ে
‘তা লে বান নেতারা আল কায়েদার প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অভিযোগ’ তুলে আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় নর্দার্ন আ্যালায়ান্স নামে তা লে বান বিরোধী একটি আফগান মিলিশিয়া গোষ্ঠীর মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে তা লে বানকে ক্ষমতাচ্যুত করে তখন। এর মাধ্যমে শুরু হয় এ শতাব্দীর ভয়ংকর আফগান যুদ্ধ।
তা লে বানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আলোচনা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারীতে কাতারের রাজধানী দোহায় দুই পক্ষের মধ্যে যে শান্তি চুক্তি হয়, তার শর্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করবে এবং তা লে বানও আর মার্কিন বাহিনীর ওপর কোন হামলা চালাবে না। চুক্তির আরও শর্তের মধ্যে ছিল তা লে বান আর আল কায়েদা কিংবা অন্য কোন জঙ্গী সংগঠনকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আশ্রয় দেবে না এবং আফগান শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাবে।
আফগানিস্তান ছিল আমেরিকার জন্য লস প্রজেক্ট। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মত এখান থেকে কোনো প্রেট্রো ডলার অর্জন তো দূরের কথা নিজের পকেট থেকে খুয়াতে হয়েছে কাড়িকাড়ি অর্থ। আফগান যুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছে আমেরিকে। এর বাইরে হিউম্যান কস্ট তো আছেই। এ যুদ্ধে গত ২০ বছরে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৬০ হাজারেরও বেশি সদস্য মারা গেছে। সাধারণ বেসামরিক আফগানের মৃত্যুর সংখ্যা লক্ষাধিক। অপরদিকে প্রায় ২৩০০ মার্কিন সেনার সাথে ৪৫০ জন ব্রিটিশ সৈন্য ও ন্যাটোর অন্যান্য কয়েকটি দেশের কয়েকশ সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে। আর নেটো জোটের আহত ও পঙ্গুত্ব বরণকারী সৈন্য সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। সবকিছু বিবেচনায় আবার আফগানে পরাজিত আরেক পরাশক্তি আমেরিকা।