ছোটবেলা থেকেই পঞ্চভূত কথাটি শুনে আসছি এবং মনে মনে ধারণা করে আসছি পাঁচটি খুবই শক্তিশালী ভূত বা অশরীরি আত্মা বা প্রেতাত্মার অজানা উপস্থিতির কথা। মানুষ মরে যাবার পরে যে সমস্ত আত্মা সুখী হয় না এবং যে সমস্ত মানুষের অপমৃত্যু হয়- তাদের আত্মা অশরীরি ভূত হয়ে মানুষের অকল্যাণ করে বেড়ায়- আবহ সংস্কৃতির এই প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাস নিয়েই সাধারণত সবাই বেড়ে ওঠে। পঞ্চভূতের এই ভূত আসলে সেই ভূত না, এ ভূত অন্য ভূত।
ভৌত শব্দটির অনেকগুলি অর্থ আছে- কিছু অর্থ অশরীরি আত্মা বা প্রেতাত্মা সম্পর্কিত, যেমন- ভূতসম্বন্ধীয়, ভূতঘটিত, ভূতের দ্বারা কৃত, ভৌতকাণ্ড ইত্যাদি এবং কিছু অর্থ বস্তু, জগৎ এবং প্রকৃতি সম্বন্ধীয় যেমন- ভৌতবিজ্ঞান, ভৌতকাঠামো, ভৌতজগৎ, ভৌতজ্ঞান ইত্যাদি। আমরা যা কিছু দেখি বা অনুভব করি, যেমন- মাটি, বায়ু, বালি, পানি, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পদার্থের অতিক্ষুদ্র- অণু, পরমাণু, ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি মিলেই ভৌতজগৎ এবং এ সবই ভৌত জগতের উপাদান। পঞ্চভূতের ভূত অংশটি এই ভৌত থেকে উদ্ভূত।
প্রায় পনেরো হাজার বছর আগের ঋষিগণ ধারণা করেছিল এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বা মহাজগৎ পাঁচটি ভৌত জিনিস থেকে সৃষ্ট এবং ধ্বংস বা লয় হবার পরে আবার ওই পাঁচটি জিনিসেই পরিণত হবে। এই পাঁচটি ভৌত জিনিস এক থেকে অন্যে রূপান্তরযোগ্য। এই পাঁচটি ভৌত জিনিসকে বলা হয়- পঞ্চভূত। পাঁচটি ভৌত জিনিস হলো- ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত ও ব্যোম।
ক্ষিতি অর্থ মাটি বা পৃথিবী, পঞ্চভূতের রূপক অর্থে ক্ষিতি হলো মহাজগতের সকল প্রকার কঠিন পদার্থ। অপ অর্থ পানি, পঞ্চভূতের রূপক অর্থে অপ হলো মহাজগতের সকল প্রকার তরল ও তরল জাতীয় পদার্থ। তেজ অর্থ অগ্নি, পঞ্চভূতের রূপক অর্থে তেজ হলো মহাজগতের সকল প্রকার শক্তি। মরুত অর্থ বায়ু, পঞ্চভূতের রূপক অর্থে মরুত হলো মহাজগতের সকল প্রকার গ্যাসিয় বা বায়বীয় পদার্থ। ব্যোম অর্থ আকাশ, পঞ্চভূতের রূপক অর্থে ব্যোম হলো মহাজগতের বিশাল মহাশূন্য।
সংস্কৃতিতে প্রকৃতি হলো- প্রকরোতি সর্বম্ ইতি; অর্থাৎ সমস্ত কিছু যার মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি হয় বা যার দ্বারা সৃষ্টি হয় তাহাই প্রকৃতি। পঞ্চভূত এই প্রকৃতির অনেকটা সম্পুরক শব্দ। প্রকৃতি আসলে পঞ্চভূতে নির্মিত। পঞ্চভূতই সৃষ্টির মূল, সৃষ্টির মধ্য এবং সৃষ্টির শেষ। ঋষিমতে পঞ্চভূত বা প্রকৃতি সংযোগে হয় চৈতন্য এবং বিয়োগে হয় মৃত্যু।
পঞ্চভূত যখন একত্রিত হয় তখন তিনটি গুণের সমাবেশ হয়। ঋষিমতে এজন্য প্রকৃতি ত্রিবিধ গুণ সম্পন্না- সত্ত্ব, রজো ও ত্বম। সত্ত্বগুণ- সুখাত্বক, স্বচ্ছ, লঘু, ও প্রকাশক। রজোগুণ- দুঃখাত্মক, চঞ্চল ও চালক/প্রবর্তক। তমোগুণ- মোহাত্মক, গুরু, আবরক ও নিয়ামক। এই ত্রিগুণের যথাযথ সমন্বয় মানববোধ এবং ত্রুটিপূর্ণ সমন্বয় অহংবোধের সৃষ্টি করে। এই অহংবোধই মানবতার পথে আবরণ সৃষ্টি করে যা সত্যিকারের মানুষকে ঢেকে রাখে।
লালন ফকির, বিজয় সরকার-সহ বহু সাধক, কবি ও লেখক ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত, ব্যোমে বা পঞ্চভূতে শান্তি অন্বেষণের কথা বলে গেছেন। আমরা তাদের কথা শুনিনি- এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছি, মোটেও অনুসরণ করিনি। আমরা ত্যাগবাদী হতে পারিনি, হয়েছি ভোগবাদী, চরম ভোগবাদী।
নষ্ট রাজনৈতিক চর্চা এবং আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার লড়াই ও চর্চা যেখানে বিদ্যমান সেখানে মানুষকে মোটেই মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, বিবেচনা করা হয় তার ক্ষমতা ও অবস্থান। ফলে উঁচু ক্ষমতা ও অবস্থানের মানুষগুলো রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। তাদের অধিকার ও ব্যাপ্তি অসীম এবং মাত্রা ছাড়া। ক্ষমতাহীন ও নিচু অবস্থানের মানুষগুলো এই নষ্টবৃত্তের তথাকথিত উঁচুদের পদসেবক মাত্র। কাগজ-কলমে এদেরকে ক্ষমতার মালিক বলা হলেও প্রকৃত অর্থে এরা ওপরওয়ালাদের সেবাদাস, এরা ভারবাহী কিন্তু ফলভোগী নয়।
সকল মানুষকে মানুষের অধিকার দেবার জন্য দেশে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চর্চা ও সুশাসন থাকতে হয়। বাংলার ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত, ব্যোমের কোথাও তা নাই, কখনও ছিলো না, ভবিষ্যতে আসার কোনো লক্ষণও নাই। তারপরও আশাবাদী হই, ওই আশাটুকুই যে আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল।