কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ব্যতীত বর্তমান পৃথিবীর গোটা সমাজব্যবস্থাই পুরুষ নিয়ন্ত্রিত বা পিতৃতান্ত্রিক।কিন্তু সভ্যতার ঊষালগ্নে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই সমাজব্যবস্থা ছিল নারী নিয়ন্ত্রিত বা মাতৃতান্ত্রিক। কৃষির আবিষ্কার, বুননশিল্প, মৃৎশিল্প ও গৃহ নির্মাণশিল্প ইত্যাদির আবিষ্কারও করেছিল নারীরা।
প্রাচিনকালের মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতাগুলোর নিদর্শন পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এমনই একটি প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার নিদর্শন হলো চীনের শিয়ান প্রদেশের বানপো।
চীনের যে সভ্যতার কথা আমরা সচরাচর জেনে থাকি তা হলো পাঁচহাজার বছর আগের। তারো চেয়েও হাজার বছরের পুরানো, সেই নতুন প্রস্তর যুগে চীনের শিয়ান প্রদেশে উন্মেষ ঘটেছিল বানপো নামে মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার।
দেয়াল বেষ্টিত শিয়ান প্রদেশের বাইরের ওভাল আকৃৃতির এ গ্রামটি পঞ্চাশহাজার স্কয়ার মিটার জায়গা জুড়ে অবস্থিত। সেই গ্রামে বড়,মাঝারী, এবং ছোট নানান আকৃতির পাঁচশটি ঘর, দুশোটি খাবার মজুদ করার ভাণ্ডার, ছয়টি মৃৎশিল্প কারখানা এবং আড়াইশোটি কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। বানপো সভ্যতার নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করার লক্ষে সেখানে ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বানপো যাদুঘর। সেখানে বিদেশী পর্যটকদের সুবিধার জন্যে যাদুঘরের চারদিকে ইংরেজীতে এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখা রয়েছে।
অন্যান্য সব মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার ন্যায় বানপোর পুরুষেরা ছিল মায়ের পরিবারের অন্তর্গত। তারা মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হতো। ছয় হাজার বছর আগে বানপোদের সেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজে, আজকের মত এক নারী এক পুরুষের মধ্যে কোন বিয়ের প্রচলন ছিলনা। উপযুক্ত মেয়েরা একাকী এক ঘরে বসবাস করতো। রাতে তাদের ঘরে যে কোন পুরুষের অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল। সকালে তাদের সেই সম্পর্কের ইতি ঘটতো। ছেলেরা আবার ফিরে যেত মায়ের কাছে, থাকতো নানা রকম সাংসারিক কাজে ব্যপৃত।
এযুগের মত তাদের সমাজে কোন স্থায়ী সম্পর্কের স্থান ছিলনা। প্রত্যেক নারী পুরুষই, একাধিক নারী পুরুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল।তবে তাদের মধ্যে যদি ভালোবাসা তৈরী হতো তাহলে সম্পর্কটা হয়তো কিছুদিন দীর্ঘস্থায়ী হতো। এ নিয়মের ফলে এদের সন্তাদের কাছে পিতৃ পরিচয় চিরদিনই অজানা থেকে যেত। এমনকি মায়েরাও জানতোনা তাদের সন্তানের পিতা কে !
সন্তানরা তাদের মাকেই চিনতো এবং মায়ের দ্বারাই সমাজপ পরিচিত হত। বানপোদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা আবর্তিত ছিল শিকার, কৃষিকাজ আর মাছধরাকে কেন্দ্র করে।
ছিপ এবং বড়শীর প্রাপ্তি থেকে বুঝা যায় তাদের অন্যতম পেশা ছিলো মাছ ধরা। তাছাড়া পাথর দিয়ে তাদের তৈরী কুড়াল, ফসল কাটার কাঁচি থেকে শুরু করে প্রায় ৫,২৭৫ টি কৃষি যন্ত্রপাতি মাটির গর্ভ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ সমস্ত তথ্য প্রমান করে যে সেই নব্যপ্রস্তরযুগেই বানপো গোত্রের মানুষরা কৃষি বিপ্লবের সুচনা করেছিল।তারা শুধুমাত্র শিকার নির্ভর নৃগোষ্ঠী ছিলো না। তারা কৃষিভিত্তিক সভ্যতাও গড়েছিলো।
রান্নার বিভিন্ন তৈজসপত্র থেকে অনুমান করা যায় যে তারা আগুনের ব্যবহার জানতো, অর্থাৎ তারা কাঁচা খাবার খেতোনা।
বানপোদের তৈরী রঙ্গিন নকশা করা হাড়িকুরি তাদের সেই গৃহস্থালী জিনিসপত্র গুলো ছিল বিভিন্ন আকৃতির। পদার্থ বিজ্ঞানেও যে তাদের ধারনা ছিল তা লক্ষ্য করা যায় তাদের একটি বিশেষ ধরনের পানির পাত্র দেখে, যা সে সময়ের তুলনায় বিস্ময়কর!
কুজোর মত এই মাটির পাত্রটি পানিতে ছেড়ে দিলে কাত হয়ে পানি ভরতে পারতো। যখন ভরে যেত তখন নিজে নিজেই সোজা হয়ে যেত। এ থেকে পানি কখনো উপচে পড়তোনা কারন এর মুখটা ছিল সরু। দুদিকে আংটা লাগানো এই জগটা বহন করাও ছিল সুবিধাজনক। বহন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে এর সুচালো গোড়াটা মাটিতে গেথে রাখা যেত সহজেই। কি অসম্ভব বুদ্ধিমান ছিলো সে জাতি!
এছাড়াও বানপোদের সেই গ্রামে বিভিন্ন শিল্প কর্মের প্রচুর নিদর্শনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জন্য মাটি দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির তৈজসপত্র নির্মানে তারা ছিল সুনিপুণ। এমনকি সেই সব ঘর গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহৃত প্রতিটি জিনিসেও তাদের শিল্পী মনের পরিচয় লক্ষ্য করা যায়। যেমন এগুলোতে তারা নানারকম রঙ দিয়ে বিভিন্ন নকশা একেছে । এছাড়াও আকাঁ আছে বিভিন্ন পশু, পাখি বা মানুষের মুখ।
তারা হাড়, দাঁত বা ঝিনুক দিয়ে তৈরি করতে
পারতো অসাধারন ডিজাইনের গলার হার,
হাতের বালা, কানের দুল প্রভৃতি। এসবের নমুনা
পাওয়া গিয়েছিল বানপো নারীদের সমাধিগুলোতে। অন্যান্য অনেক প্রাচীন সভ্যতার ন্যায় সেখানেও কবর দেওয়ার সময় মৃতদেহের সাথে জিনিসপত্র দেওয়ার প্রচলন ছিল।
তবে তাদের সমাজ যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ছিল তার প্রমাণ নারী ও পুরুষের কবরে পাওয়া জিনিসপত্রের পার্থক্য। বানপো সমাধিক্ষেত্রে একটি নারী শিশুর কবরে দেখা যায় ৭৯টি বিভিন্ন জিনিস। অপরদিকে একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের সমাধিক্ষেত্রে পাওয়া যায় মাত্র ৩-৪ টি জিনিস।
পৃথিবীতে সবকালে সব জায়গায় পুরুষরাই নেতৃত্ব দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে ও তারাই নেতৃত্ব দিবে এরকম ধারণা যাদের বদ্ধমূল, তাদের সেই ধারণা মূলে আঘাত করে এই বানপো সভ্যতা।