বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩, ০২:৩৬ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ :

বেদনা বিধুর প্রেমের স্বাক্ষী চন্দ্রাবতীর মন্দির

তপন রায় / ৮৩৫ বার
আপডেট সময় : মঙ্গলবার, ২ মার্চ, ২০২১

মধ্যযুগের এক বেদনা বিধুর প্রেমের স্বাক্ষী চন্দ্রাবতীর মন্দির : নীলগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ

বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর জন্ম দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে। চন্দ্রাবতী অমর হয়ে আছেন ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র ‘জয়-চন্দ্রাবতী’ উপাখ্যানের নায়িকারূপে।

কিশোরগঞ্জ জেলা শহর হতে পাঁচ মাইল উত্তরে নীলগঞ্জ পাশে ফুলেশ্বরী নদীর পরেই গ্রাম পাতুয়াইর। এই গ্রামেই জন্ম নেন কবি চন্দ্রাবতী।

মধ্যযুগের অন্যতম বিশিষ্ট কবি ছিলেন পিতা দ্বিজবংশী দাশ, ‘মনসা মঙ্গল’ কাব্যের অন্যতম রচয়িতা।

ফুলেশ্বরীতে ডুবে আত্মহত্যার পূর্বে চন্দ্রাবতী কে লিখা জয়ানন্দের পত্র –

‘ভাল নাহি বাস কন্যা এ পাপিষ্ঠ জনে
জন্মের মতন হইলাম বিদায় ধরিয়া চরণে
একবার দেখিয়া তোমা ছাড়িব সংসার
কপালে লিখেছে বিধি মরণ আমার’

দ্বিজ বংশীদাস মেয়েকে সান্ত্বনা দেন-
‘তুমি যা লইয়াছ মাগো সেই কাজ কর
অন্য চিন্তা মনে স্থান নাহি দিও আর’

অনুশোচনায় দগ্ধ জয়ানন্দ গোধুলীলগ্নে চন্দ্রাবতীর মন্দিরে গিয়ে দাঁড়ান অনুতপ্ত হৃদয়ে।

দ্বাররুদ্ধ মন্দিরে ধ্যানমগ্ন চন্দ্রাবতী কর্ণকুহরে পৌঁছে নি অনুশোচনায় দগ্ধ প্রেমিকের আর্তনাদ।

‘দ্বার খোল চন্দ্রাবতী দেখা দাও আমারে
না ছুঁইব না ধরিব দূরে থ্যাকা খাড়া
ইহ জন্মের মতন কন্যা দেও মোরে সাড়া
দেব পূজার ফুল তুমি গঙ্গার পানি
আমি যদি ছুঁই কন্যা হইবা পাতকিনী’

সাড়া না পেয়ে লালবর্ণের সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে মন্দির দ্বারে জয়ানন্দ লিখে যান চার ছত্রের পদ –

“শৈশব কালের সংগী তুমি
যৈবন কালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর
তুমি চন্দ্রাবতী ’’

মন্দির থেকে বেরিয়ে ছড়ানো এই ফুলে দেবালয় কলুষিত হয়েছে ভেবে তা পরিষ্কার করতে চন্দ্রাবতী ফুলেশ্বরীতে যান জল আনতে। তখনই ফুলেশ্বরীতে ভাসতে দেখেন জয়ানন্দের নিথর দেহ।

জয়ানন্দের আত্মহত্যার আঘাত সইতে পারেনি অভাগী চন্দ্রাবতী । নিজেও ডুবে মরেন ফুলেশ্বরীর জলে ।

জয়ানন্দের সুদ্ধা গ্রাম বা ফুলেশ্বরী কোনো কিছুরই এখন আর চিহ্নমাত্র নেই। তবে টিকে আছে পাতুয়ারী আর চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির। জনশ্রুতি রয়েছে, পাশের ছোট মন্দিরটি দ্বিজ বংশীদাসের।

চন্দ্রাবতীকে প্রথম জনসম্মুখে নিয়ে আসেন ১৮ শতকের কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ, তার শ্রেষ্ঠকর্ম ‘চন্দ্রাবতী’ পালাকাব্যে। ১২টি অধ্যায়ে ৩৫৪টি ছত্রের এই একমাত্র লোকগাঁথাই বাংলা সাহিত্যে চন্দ্রাবতীর জীবনীর তথ্যভিত্তিক নির্ভরযোগ্য একমাত্র প্রামাণ্য দলিল।

নয়ানচাঁদের পালা থেকে জানা যায়, বাল্যকালে চন্দ্রাবতীর বন্ধু ও খেলার সঙ্গী ছিলেন অনাথ বালক জয়ানন্দ।

ফুলেশ্বরী নদীর এপারে পল্লীতে চন্দ্রাবতীর বাস আর ওপারে সুন্ধা গ্রামে জয়ানন্দের পিতৃবসতি।

অনাথ জয়ানন্দ পালিত হচ্ছিলেন মাতুলালয়ে।

পুকুর পাড়ের ফুল বাগানে পূজার ফুল তোলার সময় পরিচয় হয় দু জনের। তা থেকেই ক্রমে সখ্যতা গড়ে ও প্রণয়। অবশেষে পারিবারিকভাবে স্থির হয় দু জনের পরিণয়ের দিন।

ওদিকে, স্থানীয় মুসলিম শাসক কাজীর মেয়ে আসমানীর অসামান্য রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়েন জয়ানন্দ।

ত্রিভূজ এই প্রেমের ভিত্তিতেই রচিত হয় বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ এই প্রেমাখ্যান।

চন্দ্রাবতীর সঙ্গে প্রণয়ের কথা জেনেও আসমানী সম্মত হয় জয়ানন্দকে বিয়ে করতে।

কাজী জয়ানন্দকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে কাজী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন জয়ানন্দকে।

একইদিনে সন্ধ্যায় স্থির ছিলো চন্দ্রাবতীর সঙ্গে জয়ানন্দের বিয়ের লগ্ন।

কনের সাজে অপেক্ষা করে চন্দ্রাবতী। বিয়ের আসরে আসে নি জয়ানন্দ।

জয়ানন্দের আসমানীকে বিয়ের সংবাদের আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন চন্দ্রাবতী।

নয়ানচাঁদের ভাষায়-
‘না কাঁদে না হাসে চন্দ্রা নাহি কহে বাণী
আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী
মনেতে ঢাকিয়া রাখে মনের আগুনে
জানিতে না দেয় কন্যা জ্বলি মরে মনে’

এরপর থেকে শুরু চন্দ্রবর্তীর বেদনাবিধুর দিন।

শোক ভুলতে তিনি বাবার কাছে অনুমতি চান চিরকুমারী থেকে নিজেকে শিবের সাধনায় নিবেদন করবেন।

মেয়ের দুখ ভোলাতে ফুলেশ্বরীতীরে পিতার তৈরি শিবমন্দির নীরব সাক্ষী হয়ে টিকে আছে চন্দ্রাবতীর স্মৃতি নিয়ে।

বিয়ের কিছুদিন পর আসমানীকে ছেড়ে মোহমুক্ত জয়ানন্দ ফিরে এসেছিলেন চন্দ্রাবতীর নিকট । এর পরই ঘটে জয়ানন্দ আর চন্দ্রাবতীর করুণ পরিণতি।

জীবনীভিত্তিক কাব্য সাহিত্য নাটকে রচয়িতারা নিজের মাধুরী মেশাবেন তাঁদের কাব্যে সাহিত্যে। তাই সব কিছু আক্ষরিক অর্থে নেয়ার সুযোগ নেই।

তবে চন্দ্রাবতী সত্য, জয়ানন্দ সত্য আর সত্য তাদের করুণ পরিণতি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর
Theme Created By ThemesDealer.Com