পৃথিবীতে প্রায় ৫,০০০,০০০ জাতের ছত্রাকের (fungus) মাত্র ১% সম্পর্কে মানুষ জানে। মোট ছত্রাকের মাত্র ১৪,০০০ ব্যাঙের ছাতা/মাসরুম। এরা আবার ৩ ভাগে বিভক্তঃ খাদ্যোপযোগী, ম্যাজিক এবং বিষাক্ত। মনে করা হয় প্রায় ৫০ টি প্রজাতির ব্যাঙের ছাতা মানুষের খাদ্যোপযোগী।
বাংলাদেশে মোটামুটি ২০ প্রজাতির ব্যাঙের ছাতা দেখা যায়। এর মধ্যে ৫-৬ টি প্রজাতি বিষাক্ত। কিছু প্রজাতি পার্বত্য জনপদের মানুষ রান্না করে খায়। বাংলাদেশে চাশ হয় Oyster mushroom হিসেবে পরিচিত প্রধাণত (৯৭%) Pleurotus spp জাতের মাসরুম।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষ ব্যাঙের ছাতা খাচ্ছে। চিলির প্রত্নতাত্বিক গবেষণায় ১৩,০০০ বছর আগের খাদ্যোপযোগী ব্যাঙের ছাতার জীবাস্ম পাওয়া গেছে। ইয়োরোপে খ্রীপূ ৩,৪০০-৩,১০০ বছর পূর্বের মমিতেও মাসরুম দেখা গেছে। মাসরুম উৎপাদনে চীন সবার উপরে।
বাংলাদেশে JICA’র আর্থ-কারিগরি সহযোগীতায় ১৯৭৬-৭৭ সনে সাভারে মাসরুমের বানিজ্যিক চাষ শুরু হয়। আমি ১৯৭৮ সনে ওই প্রকল্পটি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ব্যাঙের ছাতাও মানুষের একটি পুষ্টিকর খাবার, তা জেনে চমকিত হয়েছিলাম। বাংলাদেশে এখন বছরে ৪০,০০০ টনের বেশী ব্যাঙের ছাতা উৎপাদন হয়, যার মূল্য প্রায় ৮০০ কোটি টাকা (Mushroom Development Institute, Savar, 2020)।
ব্যাঙের ছাতাকে ইংরেজীতে Mushroom (Agaricus camestris) ও স্থানীয় বাংলায় ভূঁইছাতা/কোড়ক ছাতা/ছত্রাক/ ভুঁইছাতি/ ছাতকুড় বলে। প্রকৃতি বিজ্ঞানী Carl Linnaeus ১৭৫৩ সনে এ ছত্রাকটির কথা প্রথম বলেন। প্রজাতিটির লাতিন শব্দের অর্থ “of the fields”। এদের সাধারন নামগুলো হচ্ছে “meadow mushroom”, “pink bottom”, এবং “field mushroom”।
মাসরুম ভেজা মাটিতে, মাঠেঘাটে পচনশীল জৈব পদার্থে জন্মে। এরা মৃতজীবী বলে সালোকসংশ্লেষন করতে পারেনা। পচা জৈব কার্বন তাদের শক্তির উৎস। একটি সাদা কান্ড ও গোলাকার ছাতা নিয়ে গাছ। ৩-১২ সেমি ব্যাসের ছাতাটি সাদা এবং সুক্ষ আইসে ঢাকা। কান্ডটি ৬-৭ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা। ছাতার নীচে পাতলা পর্দা (lamella) থাকে। একে ফুলকা (gill) বলে (চিত্র)। ফুলকা দেখতে পাটল বর্ণ, পরিপক্কতায় লাল-বাদামি রং ধারণ করে। ফুলকার মুখ্য কাজ বীজগুটি ছড়ানো। এদের প্রাকৃতিক কিছু প্রজাতি বিষাক্ত, কিছু খাদ্যোপযোগী। এশিয়া, ইয়োরোপ, উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা এবং নিউজিল্যান্ডে গ্রীষ্মের বৃষ্টির পর সেতসেতে ঘাষে মাসরুম দৃশ্যমান। পাশ্চাত্যের গ্রোসারিতে মাসরুম জনপ্রিয়।
পুষ্টিঃ ব্যাঙের ছাতায় আমিষ, আঁশ, শর্করা ও চর্বিজাতীয় উপাদান প্রচুর। এতে জলীয় অংশ ৯২%। প্রতি ১০০ গ্রাম সাদা ব্যাঙের ছাতায় (Agaricus bisporus) শক্তি ২২ কিক্যা, শর্করা ৩.৩ গ্রা, চর্বি ০.৩ গ্রা, আমিষ ৩.১ গ্রা এবং প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ও খনিজ থাকে। গর্ভবতী মায়েরা মাশরুম খেলে প্রাকৃতিকভাবেই নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
ঔষধিঃ ঐতিহ্যগতভাবে স্কটল্যান্ডে ত্বক পোড়া ও প্রদাহ কমাতে, কিছু প্রজাতির আহরিত জল ইন্স্যুলিন নিঃসরন ও রক্তের শর্করা বিপাকে সাহায্য করে। হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে, কোষ্ঠবদ্ধতায়; আমাশয়, দাঁতের মাড়ির ক্ষত নিরাময়, আলসার, ডেঙ্গু জ্বর ও হেপাটাইটিস-বি প্রতিরোধক, শরীরের কোলেস্টেরল হ্রাস, নার্ভ ও স্পাইনাল কর্ড সুস্থ রাখা, কিডনি ও অ্যালার্জির প্রতিরোধক হিসেবে মাসরুমকে বিবেচনা করা হয়।
সতর্কতাঃ মাসরুমের বিষাক্ত প্রজাতী গুলো মানুষের মৃত্যুর কারন হতে পারে। বাঙ্গালীর আঙ্গিনায় যে সাদা ব্যাঙের ছাতা জন্মে, তা খাওয়া যাবে না। এছাড়া যাঁদের গেটে ব্যথা আছে, তাঁদের না খাওয়াই ভালো।
অনুপ্রেরণাঃ ব্যাঙ বা ছাতার সঙ্গে গাছটির কোন সম্পর্ক নেই। ছাতার নীচে বৃষ্টিতে ব্যাঙ আশ্রয় নেয় বলে মানুষ বলে “ব্যাঙের ছাতা”। ছড়াকার সুকুমার রায় শিশুদের উপযোগী “ছাতার মালিক” নামে একটি গল্প লিখেছিলেন। চাইলে গুগুলস থেকে তা পড়ে নিতে পারেন। “তাদের আড্ডা ছিল, গ্রাম ছাড়িয়ে, মাঠ ছাড়িয়ে, বনের ধারে, ব্যাং-ছাতার ছায়ার তলায়। ছেলেবেলায় যখন তাদের দাঁত ওঠেনি, তখন থেকে তারা দেখে আসছে, সেই আদ্যিকালের ব্যাঙের ছাতা। সে যে কোথাকার কোন ব্যাঙের ছাতা, সে খবর কেউ জানে না, কিন্তু সবাই বলে, “ব্যাঙের ছাতা।”