১.
শহরের নীলশিরা রাজপথ চলতে চলতে যেখানে ধুলো মেখে রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে, সেখান থেকেই শুরু হয় টোকাইদের আস্তানা– জাঙ্কইয়ার্ড, ল্যান্ডফিল। এখানেই গৈরিক একদিন দেখেছিল শরালির বিল। আবর্জনায় ভরাট হতে হতে এতদিনে তা রাস্তার সমান হয়েছে। এখনো তা ভরে চলেছে স্ফীতোদরে। শহরপ্রান্তে যাবতীয় বিল-ঝিল-জলাশয়ের অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে, অথচ শহরের বর্জ্য বেড়েই চলেছে দিন দিন। এসব বর্জ্য কোথায় গিয়ে জমছে, মধ্য-শহরের মানুষ তা জানে না। কেবল চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান ভাসপাখি চিল ও শকুন জানে, কীভাবে আবর্জনার ভেড়িবাঁধ ঘিরে আছে এ শহর।
ছবি আঁকা ইজেল ঘাড়ে করে জাঙ্কইয়ার্ডে পথ হাঁটে গৈরিক। এমনিতে খরা মৌসুম, হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে রাতে। এখন তাতাল-রোদের খন্তি আবর্জনার শরীর খুঁড়ে খুঁড়ে উস্কে দিচ্ছে দীর্ঘদিন জমে থাকা পূতিগন্ধময় বাষ্প। এই বাষ্প ঢুকে পড়ছে প্রহরের ফুসফুসে, পোশাকের ভেতর দিয়ে গৈরিকের প্রতি রোমকূমে। অন্তঃসত্ত্বার মত মুহুর্মুহু গা গুলিয়ে উঠছে তার। তবে মনে মনে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে সে… আহা কি সুবাস ভেসে আসছে ময়লার ডিপো থেকে, কি সুগন্ধ ভেসে আসছে পৌরাণিক মশলার দ্বীপ থেকে!
জুতোর মাথায় ঠোকর খেয়ে প্রায় উল্টে পড়ছিল গৈরিক। ঘাড়ে চাপা তিন-ঠ্যাং ইজেলের ঝুঁকি সামলে নিয়ে পতনের সূত্র খোঁজে সে। মরচে ধরা কয়েকটা লোহার দাঁত মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। জুতোর গোড়ালি দিয়ে আঘাত করতেই মাটি ফেটে একটি গোলাকার অবয়ব ফুটে বেরুল। দুহাতে দাঁত ধরে টান মারতেই উঠে এল এক গাড়ির যন্ত্রাংশ, গিয়ারের চাকা। এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে চাকাটা বেশ পছন্দ হল গৈরিকের। জাঙ্ক-আর্ট তৈরির এক মোক্ষম জিনিষ পাওয়া গেছে।
আবর্জনার শিরদাঁড়ায় বোশেখি-ধূসর পাতিকাকের মেঘ। লম্ফে লম্ফে খাবার সন্ধানে ব্যস্ত। বস্তা-পিঠে তাদের ফাঁকফোঁকরে নাঙা পায়ে ঘুরছে টোকাই ছেলেমেয়ে। রোদ লেগে তাদের বুটরঙা শরীর প্লাস্টিকের জুতোর মত চকচকে হয়ে উঠেছে। চারদিকে দৃষ্টির বৃত্ত আঁকে গৈরিক। রঙ ঝরে ঝরে এ তল্লাটে যাবতীয় বর্জ্যের রঙ কেমন ধূসর-কালো হয়ে পড়েছে। যে কোনো ধবল জিনিসই এখানে বেমানান, রীতিমত চক্ষুশূল। নিজের কালো ছায়াকে খুব নিষ্ঠাবান মনে হয় তার, কালো জুতোজোড়ার প্রতিও শ্রদ্ধা অনুভব করে সে, ভেতরের বেমানান ফর্সা পা-গুলো ঢেকে রাখার জন্য।
টোকাই-দৃষ্টি ফেলে অধোমুখে হাঁটতে থাকে গৈরিক। হাঁটতে হাঁটতেই কুড়িয়ে নেয় জাঙ্ক আর্টের উপযোগী আরো কিছু ধাতব মাল-মসলা। পথচারীকে দুদণ্ড রুখবার জন্য এই আবর্জনার নগরে নেই কোনো প্রশ্নকারী, নেই উত্তরদাতাও। উত্তল-উদর এই ল্যান্ডফিল ক্রমশ ঢালু হয়ে মিশে গেছে এক অচিন জঙ্ঘায়। চলার আয়েশে সে-দিকেই পা-পা নামতে থাকে গৈরিক। ঢালে নামার পরপরই শব্দজগতের গতিপথ থেকে ছিটকে পড়ে সে। নিঃশব্দতা চরমে উঠলে কানের ভিতর শুরু হয় টিনিটাস, একটানা ঝিনঝিন। বিরক্তিকর হলেও এমন শব্দানুভূতি শহরে বেশ দুর্লভ। দিনে তো বটেই, গভীর রাতেও। যেখানে মানুষ সচল অথবা তার অচলাবস্থায় প্রহরায় নিয়োজিত থাকে প্রভুভক্ত কুকুর, সেখানে নিস্তব্ধতা কোথায় ! এই ঢালে মানুষের দেখা নেই, এমন কি স্বল্পবাক ব্যস্ত টোকাইও।
এই নিঃশব্দতার অবসাদ থেকে তাকে মুক্তি দেয়ার জন্যই এগিয়ে আসে এক কার্টুন চরিত্র। বস্তার বেষ্টনীতে অদৃশ্যপ্রায় তার শরীর। একজোড়া সরু পা আর নাকাব চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ কথা বলে উঠল সেই কার্টুন প্রাণী, ‘স্যার আপনে কি আর্টিশ করেন?’ বস্তার খোলস নামিয়ে বের হয়ে আসে এক টোকাই যুবক।
-‘হ্যাঁ, আর্ট করি।’
-‘ঐ যে দ্যাখতাছেন কালা পানি, ঐ জাগার মইদ্যে ফাস্কিলাস্ ছবি তুলবার পারবেন। ঘর আছে, গাছভি আছে উইখানে, মন চায় তো ঠাণ্ডায় জিরায়া লন। লগে মাল না থাকলে কদ্দুর আউগাইয়া দিতাম আপনেরে।’
-‘না, ঠিক আছে, একলাই যেতে পারব।’
২.
সামনেই পাকা করমজা রঙের শীর্ণকায়া নদী। স্বচ্ছ নদী এখানে খুবই বেমানান। গৈরিক তার কালো জুতো, ধূসর ছায়া আর ময়লা জলরঙের নৈকট্যে একপ্রকার আয়েশ বোধ করে। নদীজলে ডুবে আছে ল্যান্ডফিলের অংশবিশেষ। যে আগ্রাসনে লোহালক্কড় আর আবর্জনা ডাঙা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে জলে তা দেখে মনে হয়, ল্যান্ডফিল গ্রাস করে চলেছে নিরীহ নদীকে।
একপা দু’পা করে আরেকটু জলের ধারে এগিয়ে যায় গৈরিক। কালো রবার টিউবের মত রঙওয়ালা একটি কুকুর লোহালক্কড়ের ঘুপচি থেকে মুখ বের করে। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে এক ঝলক তাকায় তার দিকে এবং পরক্ষণেই ঘেউ ঘেউ চিৎকারে রুখে আসে। আত্মরক্ষার কোনো সহজ উপায় না দেখে একটা ময়লা ঢিবির উপরেই উঠে দাঁড়ায় গৈরিক। ঘাড় থেকে ইজেল নামিয়ে প্রতিরোধ তৈরি করে। রোমহীন রবার কুকুরটা দু’পায়ে ময়লা ঠেলে উপরে উঠে আসার চেষ্টা করে, কিন্তু ইজেলের প্রতিরোধে সুবিধা করতে পারে না। আপাতব্যর্থতা মেনে নেয় কুকুরটা, সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে ঢিবির পাদদেশে।
করমজা নদীর জলের তলা থেকে ভুস করে মাথা বের করে জল-কালো এক টোকাই-কিশোরী। খালি গায়ে জল ঠেলে উঠে আসে সে। ঢিবির কাছে এসে চিৎকার করে ডাকে, ‘আই রবট, চিল্লাইস না, মানুষ দ্যাহস না।’ রবট তবু চুপ করে না। হয়ত বহুদিন পর, দায়িত্ব পালনের এক বিরল সুযোগ এসেছে তার।
কিশোরী চড়া গলায় বলে, ‘কাপর-উপর খুল্লা ফালান জলদি কইরা।’
-‘কেন?’ গৈরিক ইতস্তত করে।
-‘আবার কয় ক্যালা! অয় আপনেরে মানুষ বইলা চিনতাছে না। আপনের জান বড় নাকি জুব্বাজাব্বি!’
অগত্যা জামা খুলে ফেলে গৈরিক। রবটের আক্রমণাত্মক ঘেউঘেউ মুহূর্তেই থেমে যায়। কিশোরী বলে, ‘অহন নাইম্যা আহেন, আর চিল্লাইব না, মানুষ চিন্না ফালাইছে।’
গৈরিক ফিরে যেতে উদ্যত হয়। মেয়েটি বলে, অ্যাদ্দুর হাঁইট্যা আইছেন, এট্টু বহেন ঘরটার মইদ্যে।’ পাশেই চাকাসমেত মাটিতে প্রোথিত একটি মুড়ির টিন আকৃতির বাসের দিকে ইঙ্গিত করে সে। কৌতূহলে ভিতরে ঢোকে গৈরিক।
৩.
ল্যান্ডফিল থেকে সংগৃহীত যাবতীয় অসম্পূর্ণ জিনিস দিয়ে সাজানো একটি পোকা খাওয়া পূর্ণাঙ্গ সংসার। অধিকাংশই বাসের দেয়ালে ঝোলানো। দুয়েকটি আসনের কঙ্কাল যা বেঞ্চিতে রূপ নিয়েছে তারই একটিতে বসে পড়ে গৈরিক। বাসের দেয়ালে পারা ওঠা আয়না ঝোলানো। তার পেছন থেকে লাল ফিতে আর ক্লিপ বের করে কিশোরী, খিলভাঙা চিরুনী দিয়ে মাথা আঁচড়ে চলে সে। তার অন্তর্বাস থেকে উরুপথে চুইয়ে পড়ে করমজা নদীর জল।
গৈরিক ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালে, জিজ্ঞেস করে, ‘চা খাবে?’
-‘হ খামু। আপনে বুঝি ছবি উডান? আগেও দেখছি কয়েকজনরে আপনের লাহান, ময়লার ছবি বিচরায়। কাগজে উডাইলে ময়লার ছবি কেমুন ফিলিমের মত সুন্দর অহে। হুনছি, হেই ছবি বেইচ্যা মেলা ট্যাকা পায় তারা।’
-‘তা ঠিক। আমি মানুষের ছবিই বেশি আঁকি, সাধারণ মানুষের, যেমন তুমি। তোমার ছবিও আঁকতে পারি আমি। আর এর জন্য কিছু টাকাও তোমাকে দিতে পারি, কারণ এই ছবি বিক্রি করে আমারও কিছু লাভ হবে।’
-‘ভালা কথা, তেইলে খাড়ন, জামা পিন্দা আহি।’
-‘না-না, জামাঅলা ছবির দাম কম, কাপড় যত কম, দাম তত বেশি। কাপড় থাকলে কি আর মানুষের আসল আকার বোঝা যায়!’
-‘হুনেন আর্টিশ ভাই, আমার লগে একটা পোলায় থাকে। অয় গেছে বস্তা লইয়া বুড্ কারখানা, কাচ ফ্যাক্টরি, নানান জায়গায়, মাল বেইচ্যা আইতে আইতে বইকাল অইব, কতখন লাগব ছবি উডাইতে?’
-‘বেশিক্ষণ লাগবে না, তবে হঠাৎ কেউ এসে পড়লে…’
-‘হটাশ্ কেউ আইব না। পুরান ডিপোয় মানুষ আইব কি করতে। রবটরে খাড়া করায়া রাখুম, একটা তেল্লাচোরাও আইতে পারব না। আপনে ছবি উডান।’
মেয়েটি উসখুস করে, বারবার নড়েচড়ে ওঠে। গৈরিক বিরক্তি প্রকাশ করে, ‘তুমি কি আপেলের মত একঠায় বসে থাকতে পার না! মেয়েটি বলে, ‘কি কন, বুঝি না।’ মডেলের প্রতি শিল্পী পল সেজানের মন্তব্যটাকে এবার ঘুরিয়ে বলে গৈরিক, ‘ডিমে তা দেয়া মুরগির মত চুপচাপ বসে থাকতে হবে, এত নড়লে ছবি আঁকা যায় না।’
-‘কি করুম, উরশ কামড়াইতাছে।’
পেটিকোট পাতা কেরোসিন কাঠের প্যাকিং বাক্সটা একপাশে সরিয়ে রাখে গৈরিক। এবার কলেজ-মডেলের ভঙ্গীতে দাঁড় করিয়ে দেয় মেয়েটিকে।
গরমে উত্তেজনায় ঘেমে ওঠে কিশোরী। তার গলা থেকে বিন্দু বিন্দু ঘামের নদী জঙ্ঘা পার হয়ে পায়ের পাতার মোহনায় বিলীন হতে থাকে। তার গা থেকে ভেসে আসে ঘামে ভেজা পূতিগন্ধ। আর্ট কলেজের মডেল মেয়েদের সাথে কিশোরীর পার্থক্য হারিয়ে ফেলে গৈরিক। সব মেয়েরই কন্ঠের খাঁজে এমন জলাধারের সৃষ্টি হয় নাকি! আর সেই জল একই পথে নেমে যায় পায়ের পাতায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে নেশাকর সেই গন্ধ। গৈরিক সন্দিহান হয়ে পড়ে, তার ছবি আঁকার পথে কি বাধা হয়ে দাঁড়াবে এসব অনুভূতি! নাহ, নিজের উপর একপ্রকার বাধ্যতা আরোপ করে সে। ছবিটার নিচে আগাম লিখে ফেলে আসন্ন চিত্রমেলার ছবির শিরোনাম
– মিস ল্যান্ডফিল।
ছবি আঁকা শেষ হলে মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় গৈরিক।
-‘এত ট্যাকা! না-না এত ট্যাকা তো আমগো দরকার নাই। ঝুটা-আঁইঠ্যা খাইয়া যাগো দিন যায় এত ট্যাকা দিয়া কী করব তারা! আপনে খালি কন, আমারে একবার ছবির মেলাত লইয়া যাইবেন।’
-‘হ্যাঁ তা নিয়ে যাব, তোমার কোনো অসুবিধা না থাকলে।’
-‘না, ভেজাল আর কি, খালি মেমগো গতরের গন্ধে আমার বমি আহে।’
-‘তবুও মেলায় যেতে চাও কেন?’
-‘আমি খালি দ্যাখতে চাই, ব্যাবাক মাইন্সে আমার ছবিডা চায়া চায়া দ্যাখতাছে, কিননের লেইগা দরদাম করতাছে।’
গৈরিক উঠে গিয়ে টাকাগুলো প্রসাধনী আয়নার পেছনে রেখে আসে, ‘তোমারও টাকার দরকার আছে, ঠিক আর সকলের যেমন দরকার থাকে।’
-‘ট্যাকা যার দরকার তারেই দিয়া দিমু, আমার লাগব না। আমার ছবি উডাইলেন, চা খিলাইলেন, আমারে ভালমত এট্টু ছুঁইয়াও দ্যাখলেন না, ট্যাকা লই কেমনে!’
৪.
ফেরার পথে মুড়ির টিনের আস্তানা থেকে বের হয়ে পা বাড়াতেই যুবক-টোকাইয়ের সাথে দেখা। সে মৃদু হেসে বলল, ‘স্যার খায়েশ মিডাইয়া ছবি উডাইতে পারছেন তো?’
-‘হ্যাঁ, সকালে অতসব বস্তা নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলে?’
-‘মেলা জায়গায় স্যার, গ্যালাস ফ্যাক্টরি, বুড্ কারখানা, পেলাশটিকের দোকান। এইখানে যা কিছু পাওন যায় অর কিছুই ফালান্তি নাই। আগুন-পানিদা ধুইয়া সহরের তামাম জিনিস সহরে ফিরাইয়া দেই আমরা, মগার আমরা যাই না স্যার।’
-‘কেন যাও না?’
-‘স্যার পয়লা কথা, আমরা তো সহর থিকা আহি নাই, আর আমরা গেলেগা কামডি ক্যাঠায় করব? আপনেগো লাহান দুয়েকজন দিলওয়ালা মানুষ আহে, আমাগো আস্তানার মইদ্যে বহে, ভালমন্দ খবর লয়, এইত্তো কত!’
পড়ন্ত বিকেলে দীর্ঘ ছায়া ফেলে গৈরিক হাঁটে। তার ছায়া ল্যান্ডফিলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে দোল খায়, বেমালুম মিশে যায় ময়লার শরীরে। ছাই-সন্ধ্যার বোঁটকা বাতাসে পুরানো ডিপো থেকে ভেসে আসে টোকাই মেয়েটির কথা, ‘আমি খালি দ্যাখতে চাই, ব্যাবাক মাইন্সে আমার ছবিডা চায়া চায়া দ্যাখতাছে, কিননের লেইগা দরদাম করতাছে।’
ঘাড় থেকে ইজেল নামিয়ে পাতিকাক অন্ধকারে ‘মিস ল্যান্ডফিল’-এর ছবিটা একবার ভাল করে দেখে নেয় গৈরিক।