বিবিসিখ্যাত প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট আতাউস সামাদের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। সৎ, বস্তুনিষ্ঠ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বাতিঘর হিসেবে তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে অমর হয়ে থাকবেন ।
১৯৩৭ সালের ১৬ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার সতেরদরিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা আবদুস সামাদ ও মা সায়েরা বানুর পুত্র আতাউস সামাদের ছাত্রজীবন কেটেছে জলপাইগুড়ি, সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী এবং ঢাকায়।
বরেণ্য এ সাংবাদিকের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা করিমগঞ্জ ইউনিট একুশে বইঘরে এক স্মরণ সভার আয়োজন করেছে।
প্রতি বছরের এবারও আতাউস সামাদ স্মৃতি পরিষদ ঢাকায় তাঁর স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
আতাউস সামাদ সর্বশেষ দৈনিক আমার দেশ-এর উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আতাউস সামাদ ছিলেন সাদা মনের সরলপ্রাণ মানুষ ।
সাংবাদিক নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন আপোষহীন ও সংগ্রামী। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের (বর্তমানে ডিইউজে) দু্ই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। গণমাধ্যমবিরোধী কালাকানুনের বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন।
আতাউস সামাদের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি ১৯৫৬ সালে সচিত্র সন্ধানীতে। ১৯৫৯ সালে তিনি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাব এডিটার নিযুক্ত হন এবং ১৯৬১ সালে উক্ত পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকায় যোগ দেন এবং ১৯৬৯ সালে প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭০-’৭১ সময়কালে তিনি করাচির দি সান পত্রিকার পুর্ব পাকিস্তান শাখার ব্যুরো চিফ ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) যোগ দেন। তিনি দিল্লিতে বাসসের বিশেষ প্রতিনিধি (১৯৭২-’৭৬) এবং বাংলাদেশ টাইমস-এর বিশেষ প্রতিনিধি (১৯৭৮-’৮২) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া দীর্ঘ একযুগ (১৯৮২-’৯৪) তিনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের বাংলাদেশ সংবাদাতা ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২০ বছর। অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক এখন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে আতাউস সামাদ দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় উপদেষ্টা-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। উপদেষ্টা-সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ২০০৭ সালে তিনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবেও কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেন।
আতাউস সামাদ রাজনীতিতে সক্রিয় ভুমিকা পালন না করলেও রাজনীতিক ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী তিনি। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম রিপোর্টার ছিলেন। আতাউস সামাদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা ভাসানীর মধ্যে প্রায়স যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিক হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি ঢাকাতেই আত্মগোপন অবস্থায় ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নানা কাজে সহায়তা করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত থেকে দেশে ফেরার পথে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিমান-সঙ্গী ছিলেন, সে-সেময় তিনি তাঁর একটি মূল্যবান সাক্ষাৎকার নেন।
আতাউস সামাদ বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস নিউজ-এর জন্য সংবাদদাতা হিসেবে ঢাকায় কাজ শুরু করেন মার্শাল ল’ চলাকালিন ১৯৮২ সালের অক্টোবর থেকে। এই সময় তাঁর প্রতিবেদন মানুষকে প্রকৃত তথ্য জানাতে সাহায়তা করে। তাঁর সাহসিক রিপোর্ট সামরিক সরকারকে অনেক ক্ষেত্রেই বিব্রত করে তোলে। এসময় বিবিসি ‘হাসিনা অন্তরীণ: খালেদা আত্মগোপনে: জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের হুঁশিয়ারি’ এবং ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারী’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন সম্প্রচার করে। এ সময়ে নিরাপত্তার জন্য আরো অনেক সাংবাদিকের মতো আতাউস সামাদ আত্মগোপনে চলে যান এবং আত্মগোপনে থেকেও নিয়মিত বিবিসিকে গণঅভ্যুত্থানের ও সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করেন। বস্ত্তনিষ্ঠ সংবাদ (এরশাদ-বিরোধী) পরিবেশনের কারণে ১৯৮৭ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৯৪ – ১৯৯৫ সালে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ নিরসনে দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসানোর চেষ্টায় তাঁর ভুমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
সত্য প্রকাশে আপোষহীন আতাউস সামাদ সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংবাদিকদের দাবি আদায়ের সংগ্রামেও নিজেকে যুক্ত করেছেন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আজীবন লড়ে গেছেন। বস্ত্তনিষ্ঠ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক আতাউস সামাদ জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধ ও গণহত্যা, ১৯৭৫-এ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জারিকৃত জুরুরি অবস্থা, ১৯৭৬-এর আগস্টে নিজদেশে জারিকৃত সামরিক শাসন, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসন, ৯০ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৯২ সালে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল-বিরোধী-আন্দোলনসহ সব রকম সংকটময় পরিস্থিতিতে নিরলসভাবে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেন। অর্থাৎ যুদ্ধ, সেন্সরশিপ, সামরিক শাসন ও অগণতান্ত্রিক জরুরি অবস্থার মধ্যে দিয়ে তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের প্রায় সবটা সময় কেটেছে।
সাংবাদিকতায় গৌরবময় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমী ফেলোশিপ, বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুব উল্লাহ জনকল্যান ট্রাস্ট পুরস্কার, মহাকাল সৃষ্টি চিন্তা সংঘ কর্তৃক ভাষা শহীদ গোল্ড মেডেল, জাগৃতি চলচ্চিত্র পরিষদ কর্তৃক শিল্পী কামরুল হাসান স্মৃতি পদক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী জাতীয় স্মৃতি পরিষদ কর্তৃক শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোল্ড মেডেল এবং ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিয়ন কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা রিপোর্টার্স পদকে ভূষিত হন।
তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।